বুধবার, ২৯ মার্চ, ২০১৭

আমি মানুষ নই, মানুষের রূপধারী ওরিজিনাল বাংলাদেশি কুকুর


আমরা প্রতিদিন নতুন কতো কিছু দেখছি আর নতুন কতো কিছু শিখছি। এইতো আজ দেখলাম ডাস্টবিনের মোড়ে চার পাঁচটা কুকুর খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। কুকুরগুলি কিছুক্ষণ পর নিজেরা নিজেরা খাবার নিয়ে ঝগড়া লেগে একটি কুকুর আরেকটিকে কুকুরকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। এভাবে একটি কুকুর আরেকটা কুকুরকে তাড়াতে তাড়াতে সবগুলি কুকুর চলে গেল।
কিন্তু না এখানে দেখার বা শেখার শেষ নয়। এখানেই শুরু।



কুকুর গুলি চলে যাবার পর আড়াল থেকে লুকিয়ে থাকা একটি শিশু বের হয়ে আসলো। বয়স খুব বেশী নয় চার কিংবা পাচ বৎসর হবে মাত্র। গায়ে ছেড়া সেন্ডু গেঞ্জি আর ছেড়া হাফ পেন্ট। দেখে মনে হয় সেই উনিশত চুয়াত্তর সালের দুর্ভিক্ষ আমলের গেঞ্জি পেন্ট। শিশুটার চেহারা ও সাস্থ দেখে মনে হচ্ছে শিশুটা সেই চুয়াত্তর সালের দুর্ভিক্ষের অভিনয় করছে। কিন্তু না মোটেও সে অভিনয় করছেনা। সে একজন বিংশ শতাব্দীর ১৭ সালের বাস্তব দুর্ভিক্ষের অভিনেতা। আর আমি একজন দর্শক মাত্র।

তো যাই হোক কুকুর গুলি যে খাবার ফেলে গেল ছোট্ট শিশুটা সেই খাবার গুলি খুব যত্ন সহকারে কুড়িয়ে কুড়িয়ে খেতে লাগলো। দেখে মনে হলো সে মানুষ নয় কুকুর। অরিজিনাল বাংলাদেশী কুকুর। তখন হটাত আমার নিজের দিকে খেয়াল এলো। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি আরে আমি যে শিশুটাকে অরিজিনাল বাংলাদেশী কুকুর বলছি তার আর আমার দেহের গড়নে তো কোন পার্থক্য নেই। তবে কি আমি অরিজিনাল বাংলাদেশী ………………?
না মোটেও আমি তা মেনে নিতে পারছিনা। ওহে পার্থক্য পেয়েছি। পার্থক্যটা হচ্ছে পোশাকে। আমি নিতান্তই ভদ্রলোক পোশাক আশাকে। আর পিচ্ছিটা ছেড়াফারা সেই চুয়াত্তর সালের পোশাকে আবৃত।

পেন্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট গ্যাসলাইটার দিয়ে ধরিয়ে টানতে টানতে থাকিয়ে থাকলাম ডাস্টবিনটার দিকে। পিচ্ছি বাচ্ছাটা খাচ্ছে আর খাচ্ছে। তার চেহারার মধ্যে কোন দ্বিধা বা রোগবালাইর ভয়ের ছাপ নেই। আছে পাওয়ার আনন্দ। আছে খাওয়ার আনন্দ।

কিছুক্ষণ পর শিশুটার প্রায় কাছাকাছি একটা রোগা চেহারার শুকনা সাস্থ ওয়ালা কুকুরের বাচ্ছা এলো। কুকুরের বাচ্ছাটাকেও দেখে মনে হলো সেও চুয়াত্তর সালের দুর্ভিক্ষের সিনেমা বা নাটকের অভিনেতা। কিন্তু না, সেও বিংশ শতাব্দীর ১৭ সালের বাস্তব অভিনেতা। আর দর্শক এখনোও আমি একজন।

তো যাই হোক কুকুরের বাচ্ছাটা ছেলেটার কাছে আসতে ভয় পাচ্ছে। ছেলেটা তা বুঝতে পেরে দূর থেকে খাবার ছুড়ে দিচ্ছে। কুকুরের বাচ্ছা সেগুলি কুড়িয়ে কুড়িয়ে খাচ্ছে। বাচ্ছা ছেলেটা খুব বুদ্ধিমান। সে খারার ছুড়তে ছুরতে আসতে আসতে কুকুরের বাচ্ছটাকে কাছে নিয়ে আসলো। কুকুরের বাচ্চাটা এখন আর মোটেও ছেলেটাকে ভয় পাচ্ছেনা। তাই ছেলেটা কুকুরের বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। কোলে নিয়ে আদর করে কুকুরের বাচ্চাটাকে খাওয়াতে লাগলো। এক সময় ছেলেটা দেখতে পেল তার গায়ে রক্ত লেগে আছে। ছেলেটা বুদ্ধিমান বলে বুঝে গেল এই রক্ত কুকুরের বাচ্চার শরীর থেকে ঝরছে। সাথে সাথে সে কুকুরের বাচ্চার পা চেক করে দেখলো কুকুরের বাচ্চাটার ডান পা কেটে গেছে। সাথে সাথে সে ডাস্টবিনের পাশের দেওয়ালে বেড়ে উঠা কি একটা গাছের পাতা ছিড়ে এনে দুই হালের তালুতে ডলতে ডলতে কুকুরের বাচ্চারটার কাটা স্থানে লাগিয়ে তার ছেড়াফাড়া সেন্ডু গেঞ্জিটা খুলে নিয়ে বেঁধে দিল। আমি অবাক হলাম ছেলেটার এমন মানবিক কান্ড দেখে। এই মুহূর্তে আমি ছেলেটার কাছে না গিয়ে পারলাম না। আমি ছড়ানো ছিটানো ডস্টবিনের ময়লার উপর দিয়ে হেটে ছেলেটার কাছে গেলাম। ছেলেটা আমায় দেখেনি। কিন্তু কুকুরের বাচ্চাটা ঠিকি আমায় দেখে ফেলেছে। কুকুরের বাচ্ছাটা ছেলেটার কোল থেকে লাফ দিয়ে নেমে গিয়ে ঘেউঘেউ করে চিল্লাতে লাগলো। কুকুরের বাচ্ছাটা আমাকে ভয় দেখাচ্ছে আর ফাঁকেফাঁকে ছেলেটার ছেড়া পেন্ট ধরে টানছে। অর্থাৎ কুকুরটা আমাকে বিপদ ভেবে ছেলেটাকে নিরাপদে চলে যেতে বলছে। কুকুরের এমন মানবিক গুণ আমাকে আরো বেশী অবাক করছে। কুকুরকে আমি খুব ভয় পাই। কিন্তু ছেলেটার মানবিক কান্ড, আর কুকুরের মানবিক গুণ আমাকে এতোটাই অবাক করেছে যে আমি কুকুরের ভয় ভুলে গেছি।

ছেলেটা আমার দিকে তাকালো ভয়ভৃতি চেহারা নিয়ে। আমি হাসিমুখে ছেলেটার মাথায় হাত দিয়ে আদর করতে লাগলাম। ছেলেটা আমার এমন আচরণ দেখে অবাক চোখে একবার আমার দিকে আরেকবার কুকুরের বাচ্ছার দিকে তাকাচ্ছে। কুকুরের বাচ্চাটা আর আগের মতো ঘেউঘেউ করছেনা। সম্ভবত কুকুরের বাচ্চাটাও ছেলেটার মতো আমার আচরনে অবাক হয়ে আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। আমি আমার আরেক হাত দিয়ে কুকুরের বাচ্চাটাকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলাম। আমরা তিনজন নীরব কারো মুখে কোন শব্দ নেই। শুধু ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ। কিছুক্ষণ পর একটা কুকুর কোথা থেকে ডাস্টবিনের দিকে এসে আমাকে দেখে হার্ড ব্রেক ধরে দাঁড়িয়ে গেল। আমাদেরও তাই ঘোর কেটে গেল। আমি চার পাঁচ বছরের বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি কুকুরগুলির ভয়ে আগে লুকিয়েছিলে, কুকুর গুলি চলে যাবার পর এখানে এসে তুমি কুকুরের খাবার গুলি কুড়িয়ে খেলে। এই কুকুরের বাচ্চাটা তোমাকে ভয় পেয়ে তোমার কাছে আসতে চাচ্ছিলনা। তুমি তাকে কৌশলে কাছে নিয়ে এসে খাবার খাওয়ালে। তার কাটা জায়গা তোমার একমাত্র গেঞ্জি দিয়ে বেঁধে দিলে কেন? যেই কুকুরের ভয়ে তুমি এতক্ষণ খাবার খেতে ভয় পাচ্ছিলে সেই কুকুরের বাচ্চাকে কেন তুমি এমন ভালবাসা দিলে? কেন কুকুরটা তোমাকে আমার হাত থেকে বাঁচাতে তোমার পেন্ট ধরে টেনে তোমাকে সরে যেতে বলছিল?

শিশুটি ঘন একটা নিঃশ্বাস ফেলে আমার এতোগুলি কঠিন প্রশ্নের জবাব দিল এক কথায় “আমি মানুষ বলে তাই”।

আমার আর বোঝতে বাকি রইলোনা যে আমি যাকে ওরিজিনাল কুকুর বলেছি সে কুকুর নয় “মানুষ”। আর আমি মানুষ নই, মানুষের রূপধারী “ওরিজিনাল বাংলাদেশি কুকুর”।

আমি যদি মানুষ হতাম তবে আর কুকুরের মতো নিজে একা ভোগ করতে গিয়ে সবাইকে তাড়িয়ে দিতামনা। আমি যদি মানুষ হতাম তবে আর পথশিশুরের ছেড়াফাঁড়া কাপড় পরে আছে দেখেও নিজে নামিধামি পোশাক গায়ে দিতামনা। আমি যদি মানুষ হতাম তবে, তো এই চার পাঁচ বছরের বাচ্চাটাকে কুকুরের খাবার খেতে দিতামনা। আমি যদি মানুষ হতাম তবে তো নামিধামি সিগাটের ধরিয়ে এমন বাস্তব নাটক দেখতে চাইতামনা। না আমি মানুষ হতে পারিনি। আমি মানুষ হতে চাই। আমি মানুষের সঙ্গ পেয়ে মানুষ হতে চাই। আমি আজ এই বাস্তব অভিনয়ে দেখে শিখে নিয়েছি মানুষের সঙ্গ পেলে কুকুরের বাচ্চার মাঝেও মানুষের গুণ চলে আসে। তবে আমি কেন মানুষের সঙ্গ পেয়ে মানুষ হতে পারবনা।

তাইতো চার পাঁচ বৎসরের “মানুষ” বাচ্চাকে কোলে তুলে নিলাম। বাচ্চাটা কোলে নিল তার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে মানবিক গুণ অর্জনকারী কুকুরের বাচ্চাটাকে। তিন জন মিলে এ এক অন্য রকম নতুন মিশন “মানুষ হওয়ার মিশন” “মানুষ গড়ার মিশন”।

কোন মন্তব্য নেই: