সোমবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৫

কেউ এক জন আমায় খুব মিস করছে

সেবার ছিল ২০০৯ সাল।
ঠিক এই দিন রাতেই আমি আমার পাশের বাসার বন্ধু সুলভ বড় ভাইর সাথে ঘুমাতে যাই।
বড় ভাইটা জানতো আমি কাল সকালে ঢাকা যাব তাই দুই হাজার টাকা
আমার হাতে দিয়ে বললো এগুলি আমার কাছে থাকলে খরচ করে ফেলবো।
বরং তোর কাছে রেখেদে।
লাগলে খরচ করিস।
আমি আমার মানিব্যাগে টাকা গুলি রেখে দিলাম।
বড় ভাইটা ঘুমিয়ে পরলো।

এই রাতেই সুরঞ্জনার সাথে মোবাইলে অনেক ক্ষণ কথা হল।
তখন আমি একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করতাম।
আগামি কাল অফিসে অনেক জরুরি কাজ আছে তাই সুরঞ্জনা আর আমি
সিদ্ধান্ত নিলাম আগামি কাল অর্থাৎ ১লা বৈশাখে সুরঞ্জনার সাথে দেখা
করতে ঢাকা যাবনা।
ঐ রাতেই অনেক ঝড় তোফান শুরু হলো।
তাই মোবাইল ফোনে কথা বলতে শুনতে সমস্যা হওয়ায়
আমরা লাইন কেটে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে অফিসের উদ্দ্যেশ্যে ছুটলাম।
বাসা থেকে অফিসে হেটে যেতে ১৫ মিনিট লাগতো।
তাই হেটেই যেতাম।
ঘর থেকে বের হতেই সুরঞ্জনাকে খুব মিস করতে শুরু করলাম।
কারণ প্রতিবারই ১লা বৈশাখের আগের রাতেই রওয়ানা দেই ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে।
অর্থাৎ সুরঞ্জনার সাথে দেখা করার জন্য।
এই সকাল বেলাতেই দাঁড়িয়ে থাকতাম
সুরঞ্জনার আশে পাশের এলাকায় ওর অপেক্ষায়।
কিন্তু আজ ছুটছি অফিসে।
খুব মিস করছিলাম তাই ওকে কল দিলাম।
ওর সাথে কথা বললাম অফিসের গেইটে পৌছা পর্যন্ত।
অফিসে ঢুকতেই কয়েক জন  কলিগ এসে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন।
জাহিদ সাহেব ও রবিউল সাহেব বলে উঠলেন আপনি আজ কিভাবে অফিসে আসলেন?
আজ তো আপনার অফিসে আসার কথা আমরা চিন্তাই করিনি।
আমি মনমরা হয়ে বললাম না এসে পারলাম না ভাই।
রবিউল সাহেব বললেন কিন্তু কেউ এক জন যে খুব মিস করছেন আপনাকে।
আমি উত্তর দিতে যাবো এমন সময় জাহিদ সাহেব হাজিরা খাতা হাতে নিয়ে এসে বললেন
এসে যখন পরেছেন তাহলে সাইনটা করে নেন।
আমি হাজিরা খাতাটা হাতে নিতেই রবিউল সাহেব মজা করে খাতাটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বললেন,
আপনার সাইন করা লাগবেনা।
আপনি এখনি ঢাকা চলে যান।
এই মাত্র ঢাকা শব্দটা শুনে আমার বুকের মাঝে মুচড় দিয়ে উঠল।
আমি এক মিনিটের জন্য কোথায় হারিয়ে গেলাম।
জাহিদ সাহেব আমার ঘাড়ে হাত রেখে ঝাঁকি দিয়ে বললেন কি কোথায় হারিয়ে গেলেন।
আমি বর্তমানে ফিরে এলাম।
জাহিদ সাহেব আবার বললেন সাইন করে নিন।
আমি সাইন করবোনা,বলেই জোরে জোরে হাটতে শুরু করলাম।
রবিউল সাহেব পিছন থেকে বললেন কোথায় যাচ্ছেন?
আমি পিছনে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে বললাম
কেউ এক জন আমায় খুব মিস করছে তো তাই চলে যাচ্ছি তার কাছে।
গেইট থেকে বের হতে গিয়ে কিসে লেগে আমার শার্টের হাতের উপরের অংশ অনেকটা ছিড়ে গেল।

এই ছেড়া সার্ট নিয়েই রওয়ানা দিলাম।
সার্টটা কয়েক দিন আগেই আমার জন্মদিন উপলক্ষে সুরঞ্জনা পাঠিয়ে ছিল।
ওহ একটা না দুটি সার্ট,একটি ডাইরি,একটি কলম ও একটি বার্থ ডে কার্ড
পাঠিয়ে ছিল জন্মদিনে।

রিক্সায় উঠেই সুরঞ্জনাকে কল দিয়ে বললাম হ্যালো আমি আসছি।
তুমি অপেক্ষায় থাকো।
সুরঞ্জনা বললো পাগলামি করছেন কেন?
ও আমাকে সব সময়ই আপনি করে বলতো।
আমি তার কথার গুরুত্ব না দিয়ে বললাম আমার ৪ঘন্টার মতো লাগবে।
ওকে বলেই লাইন কেটে দিলাম।

ও বার বার কল দিচ্ছিল কিন্তু আমি রিসিভড করলাম না।
কারণ ও আমাকে এখন শাসাবে, জ্ঞান দেবে,শাশন করবে।
যাতে আমি পাগলামিটা না করি।
কোন দিনই সে আমার পাগলামিটা থামাতে পারেনি।
কিন্তু তবুও বারংবার বৃথাই চেষ্টা করে।

দুপুর ১টার দিকে যাত্রাবাড়ি গিয়ে নামলাম।
ও এখানেই অপেক্ষায় ছিল আমার জন্য।
দুজনার শুভেচ্ছা বিনিময় হলো।

ও আমার ছেড়া সার্ট দেখে বললো,ছেড়া সার্ট পরে এসেছেন কেন?
আর এটা তো নতুন সার্ট চিরলো কি করে।
আমি তার প্রশ্নের তুয়াক্কা না করে বললাম, কোথায় যাবে চলো।

ওর ইচ্ছা সাভার(স্মৃতিসৌধ্য), তাই সাভারেই চলে গেলাম।
ক্লান্তি খিদা ভুলে গিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা প্রেমবন্ত ছিলাম।

সন্ধ্যা শেষে আমরা আলুর চপ,পিয়াজু,সমুচা,সিঙ্গারা,মুগলাই,ছোলা ভুনা খেলাম।
ও আমাকে বিল দিতে দিলনা।
আমার পাচশত টাকার নোটটা তার কাছে রেখে দিয়ে সে ভাংতি টাকা দিয়ে বিল পরিশোদ করে দিল।
আমার চা সিগারেট দুটুরই বদদ্ভ্যাস ছিলো।
ফুতপাতের পাশে চায়ের স্টলের বেঞ্চে বসেই দুটুই করলাম।
আমি আবারো আরেকটা পাচশত টাকার নোট দিয়ে চা সিগারেটের বিল দিতে গেলাম।
সুরঞ্জনা এইটাও নিয়ে নিল।
তার ব্যাগ থেকে ভাংতি টাকা বের করে বিল পরিশোধ করে নিলো।
আমার সাইনোসাইটিস সমস্যাটা মোটামুটি খুব জ্বালাছিল।
কিন্তু ঔষধ তো সাথে আনা হয়নি তাই ওকে বললাম আমার কয়েকটা ঔষধ নিতে হবে।
ও ফার্মেসী দেখে আমাকে নিয়ে গেলো।
ঔষধের নাম গুলি আমার মুখস্থ ছিল তাই কোন সমস্যা হলোনা।
আমি ঔষধে দাম দিতে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে যাবো,
ও আমাকে চোখ রাঙ্গিয়ে ভয় দেখালো।
আমি আর সাহস পেলামনা।
সেই পরিশোদ করে দিল।

সাভার থেকে টেক্সিক্যাব নিয়ে আমরা সায়দাবাদ এলাম।
যানজট এর জন্য সম্ভবত পাচশত ত্রিশ টাকা বিল এসেছিল।
ও-ই পরিশোধ করলো।

এখন সময় প্রায় সন্ধ্যা সারে সাতটা।
এই বেলাতে তেমনটা গাড়ি ছাড়েনা যাত্রি কম হয় বলে।
আমি বললাম তুমি বরং বাসায় চলে যাও আমি দশটার গাড়িতেই যাই।
ও আমাকে ধমক দিয়ে বললো জি......না আমি আপনাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে যাবো।
কি বুদ্ধি আমি চলে যাই আপনি লাল নীল বেগুনী পরী দেখুন।
আমি বুঝি কিচ্ছু বুঝিনা।
আমি মৃদু হাসলাম,আর বললাম কি করবো বলো সারা দিনই তো পেতনি একটা ঘাড়ের উপর চরে বসে ছিল।
লাল নীল বেগুনী পরী দেখার সুযোগ আর সমই-ই পেলাম বা কই?
আমি ওকে খেপানোর জন্য বললাম তুই পেতনি না তো পরী নাকি?
আমরা দুজন যখন দুজনাকে খেপাতাম তখন তুই করেই বলতাম।
ওহ রাস্থার মাঝে আমার কানমুড়া দিয়ে ধরে বলে উঠলো তুই কি বললি আমি পেতনি?
আমি পেনতি?
আমি ইজ্জত বাচাতে পেতনিটাকেই তখন পরী বলে দিলাম।

একটা গাড়ি এসে লাইনে দাঁড়ালো।
ও আমাকে বললো আপনি দাড়ান আমি দেখি গাড়িটা কখন ছাড়বে।

ও কাউন্টারে গেলো ।
আমিও এই সুযোগে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলাম।

ও হাস্য উজ্জ্বল মুখ নিয়ে কাউন্টার থেকে বের হয়ে আসলো।
ওকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন ও সোনার হরিণ পেয়েছে।

আমাকে হাসতে হাসতে বললো টিকেট পেয়েছি।
টিকেটটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো এবার আমি বাসায় যেতে পারি।
ব্যাগ থেকে তিনটা পাচশত টাকার নোট বের করে দুটু আমার হাতে দিয়ে বললো,
এই দুইটা আপনার যে গুলি আমি নিয়েছিলাম।
আরেকটা নোট আমার হাতে দিয়ে বললো রাস্থায় গাড়ি বিরতি দিলে কিছু খেয়ে নেবেন।
আমি জোরা জুরাজুরি করেও টাকাটা ফেরত দিতে পারলামনা।
ও বললো আমি জানি আপনি টাকা গুলি কারো কাছ থেকে দার করে নিয়ে এসেছেন।
আমি বললাম দার করিনি একজন আমার কাছে রাখতে দিয়েছেন।
ও বললো ওই একি কথা।এবার আমায় একটা রিক্সা দেখে দিন।

ও রিক্সায় উঠে বসলো।
দুজনের চোখ অশ্রু সজল।
এ যেন ক্ষণিকের দূরে যাওয়া নয়।
চিরদিনের দূরে যাওয়া।

ও আমার মাথায় মুখে কমল পরশে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো ভালো থাকবেন,
নিজের দিকে খেয়াল রাখবেন,আর বিশেষ ভাবে স্বাস্থের দিকে খায়াল রাখবেন।
আমি তখনো অস্বাভাবিক শুকনো ছিলাম। তাই ও বিশেষ ভাবে স্বাস্থের দিকে খেয়াল রাখতে বলেছে।
আমি তার হাতটা ধরে হাতের পিঠে চুমি দিয়ে বললাম তুমিও ভালো থেক,
নিজের দিকে খেয়াল রেখ।

রিক্সা দিরে দিরে চলতে থাকলো।ওর হাতটাও দিরে দিরে আমার হাত থেকে ছুটে গেল।
যতো দূর দেখা গেল ও রিক্সার পিছন দিয়ে থাকিয়ে থেকে আমায় হাত নাড়িয়ে
বিদায় জানালো।
আমিও তাকিয়ে থেকে সুরঞ্জনা কে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালাম।
..........................................................................................
জানিনা আজ সুরঞ্জনা কোথায় আছে কেমন আছে?
যেখানেই থাকিস যেভাবেই থাকিস ভালো থাকিসরে?
বৈশাখী শুভেচ্ছা রইলো।

কোন মন্তব্য নেই: